৪ আগস্ট দুপুর ২টা। রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানের মোহরার আমিনুল ইসলামের মোবাইল ফোনে হঠাৎ একটি কল আসে। পরিচয় দেন যাত্রাবাড়ী থানার অপারেশন ইনচার্জ (ওসি)। নাম আবুল হাসান। প্রথমে অনুরোধ, কয়েকটি লাশ মাটিচাপা দিতে হবে। ইনচার্জ জানতে চান, কয়টি? ওসি জানান, ১০টি। এরপর আমিনুল ইসলাম জানিয়ে দেন, কাগজপত্র ছাড়া লাশ দাফন করা যাবে না। এতে ক্ষিপ্ত হন পুলিশ কর্মকর্তা। আমিনুলকে নানাভাবে কিছুক্ষণ হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। তার পরও আমিনুলের ভাষ্য ছিল, শরিয়ত এবং আইন অনুযায়ী না হলে তিনি কবরস্থানে কোনো লাশ দাফন করতে পারবেন না।
১০টি লাশ ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে রাজপথে নেমে আসা ছাত্র-জনতার। আন্দোলন দমাতে মরিয়া পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন তারা। হত্যাযজ্ঞের প্রমাণ ধ্বংস করতে লাশগুলো যেনতেন ধরনের মাটিচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তবে ইনচার্জ আমিনুল ইসলামের দৃঢ়তায় জুরাইন কবরস্থানে তা সম্ভব হয়নি।
ওই ১০টি মরদেহ নিয়ে পুলিশ এরপর কী করেছিল—তা উদ্ঘাটন করা অবশ্য সম্ভব হয়নি। সেগুলো কোথায় দাফন করা হয়েছিল কিংবা আদৌ তা করা হয়েছিল কি না—তা জানতে এক মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছে কালবেলা। জুরাইন কবরস্থানে গোরখোদক হিসেবে কাজ করেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করা হয় ছদ্মবেশে। তবে কোনোভাবেই তারা দাফন-সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতে চাননি। এরপর যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন ওসিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ। ব্যাচমেটদের মাধ্যমে খোঁজ নিলেও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না ওসি আবুল হাসান এখন কোথায়? গত ৩১ আগস্ট আবুল হাসানকে প্রশ্ন লিখে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হয়।
মেসেজটি সেন্ড হয়েছিল। এর কিছু সময় পর দেখা যায়, তিনি তার ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টটি মুছে ফেলেছেন।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এর বাইরে জুরাইন কবরস্থানে আরও পাঁচটি অজ্ঞাত মরদেহ দাফন করা হয়েছে। সেগুলো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জোর করে দাফন করেন। একটি সূত্রের মাধম্য অজ্ঞাত লাশ দাফনের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গত ২০ আগস্ট কালবেলার প্রতিবেদক প্রথমে জুরাইন কবরস্থানে যান। সেখানে লাশের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে কবরস্থানের দায়িত্বশীলরা সহায়তা করেননি।
এরপর তাদের কাছে থাকা লাশ দাফনের হিসাবের খাতা দেখতে চাইলে তা দিতেও অপারগতা প্রকাশ করেন। পরদিন ফের গেলে জানানো হয় সেই খাতা নিয়ে গেছেন সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন অফিসাররা। এরপর আরও অন্তত আটবার জুরাইন কবরস্থানে যাওয়া হয়। তবে তারা কোনো তথ্য দিতে পারেননি। প্রতিবারই বলা হয়, খাতা করপোরেশনের ঊর্ধ্বতনরা নিয়ে গেছেন।
দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-৫-এর সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা সাইদুর রহমান তখন জানিয়েছিলেন, ‘জুরাইনে কোনো অজ্ঞাত লাশ দাফন করা হয়নি।’
এরপর মরদেহের রেজিস্টার খাতার খোঁজে গত ১ সেপ্টেম্বর যাওয়া হয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। তবে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বারবার অনুরোধ করার পরও তারা খাতা দেখতে দেননি। তারা কোনো তথ্য দিয়েও সহায়তা করেননি। প্রধান সমাজকল্যাণ এবং বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল এ বিষয়ে কথা বলারই সুযোগ দেননি কালবেলা প্রতিবেদককে। তার ভাষ্য ছিল, ‘আমি বদলি হয়ে চলে যাচ্ছি করপোরেশন থেকে। এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না।’
জুরাইন কবরস্থান সংশ্লিষ্ট দুজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, নাম-ঠিকানাবিহীন পাঁচটি মরদেহ দাফন করা হয়েছে জুরাইন কবরস্থানে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জোর করে এটি করেছেন। এরপর আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা চেপে যেতে বলেন বিষয়টি। তবে কালবেলার পক্ষ থেকে মরদেহ নিয়ে খোঁজখবর শুরু করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ রেজিস্টার খাতা নিয়ে যান।
তবে একান্ত আলাপচারিতায় জুরাইন কবরস্থানের মোহরার আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মরদেহ দাফনের জন্য নিয়ে এসেছিলেন। তারা জোরাজুরি করেছিলেন। কিন্তু আমি কাগজপত্র ছাড়া দাফন করা যাবে না বলে জানাই। পরে তারা কাগজপত্র বানিয়ে এনে দাফন করেছেন।’
অন্য একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘লাশের হিসাবে ব্যাপক গরমিল। ইচ্ছামতো তারিখ এবং ঠিকানা বসিয়ে দাফন করা হয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তালিকা নিয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের চাপের কারণে আসলে ওই সময় কবরস্থান কর্তৃপক্ষের তেমন কিছু করারও ছিল না।’
কালবেলার প্রতিবেদকরা গত মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে এ পর্যন্ত চার দিন যান আজিমপুর কবরস্থানে। সেখানে কোনো বেওয়ারিশ কিংবা অজ্ঞাত লাশ দাফন হয়নি বলে জানান কবরস্থানের মোহরার হাফিজুল ইসলাম। তবে গত ২০ আগস্ট হাফিজুল ইসলামের কাছে লাশ দাফনের রেজিস্টার খাতা দেখতে চাইলে তিনি পরদিন যেতে বলেন। তবে ২২ আগস্ট কবরস্থানে গেলে জানানো হয়, রেজিস্টার খাতা করপোরেশনের ঊর্ধ্বতনরা নিয়ে গেছেন। গতকাল রোববার পর্যন্ত আজিমপুর কবরস্থানে যোগাযোগ করা হলেও রেজিস্টার খাতা করপোরেশনে রয়েছে বলে জানানো হয়।
একই রকম ঘটনা ঘটেছে আশুলিয়ায়। সেখানে ৭টি মরদেহ পুলিশে গাড়িতে তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। তবে ৭, ১০ কিংবা ৫টি লাশের এমন ঘটনা এখানেই শেষ নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শুধু রাজধানী থেকেই নিখোঁজ হয়েছেন অনেকে। যাদের এখনো খোঁজ মেলেনি।
টানা এক মাস কালবেলার প্রতিবেদকরা হাসপাতাল, কবরস্থানসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে ঘুরে অন্তত ৯০টি অজ্ঞাত মরদেহ রাজধানীর বিভিন্ন কবরস্থানে দাফনের প্রমাণ পেয়েছেন। যাদের দাফন করা হয়েছিল আন্দোলন চলাকালে সময়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে এখনো পড়ে আছে অন্তত ৩৫টি মরদেহ। এর মধ্যে কয়েকটি মরদেহ ভবঘুরে ব্যক্তিদের বলে রেকর্ড করা হয়েছে। পুলিশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই এমনটা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেলের মর্গ ও ফরেনসিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত রামু চন্দ্র দাস।
তথ্য বলছে, আন্দোলন চলাকালে নিহত হয়েছেন নিশ্চিত হওয়া আটটি মরদেহ ঢাকা মেডিকেলে রয়েছে। এ ছাড়া সেখানে থাকা আরও ২৭টি লাশের মধ্যে তিনটি এসেছে ৩ আগস্ট। আর ১ ও ২ আগস্ট এসেছে একটি করে লাশ। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের মর্গে একজন আন্দোলনকারীর লাশ রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন সেখানকার দায়িত্বে থাকা যতন কুমার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়মানুযায়ী অজ্ঞাত মরদেহ দাফনের আগে নিহতের পরিবার কিংবা আত্মীয়স্বজনের খোঁজ করতে হয়। নিহতের ডিএনএ স্যাম্পল রাখতে হয়। তবে এসবের কিছুই মানা হয়নি কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতদের ক্ষেত্রে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের দায় এড়াতে তড়িঘড়ি করে দাফন করেছে এসব মরদেহ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেই মরদেহ মাটিচাপা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নামে অজ্ঞাত মরদেহের ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে দাফনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আবার সংঘর্ষের সময় গুলিতে মারা গেলেও অনেক মরদেহ হাসপাতাল থেকে বের করতে দেননি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। মৃত্যুসনদে তরুণ হলে হৃদরোগ আর বয়স্ক হলে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু লিখতে হয়েছে। যে কারণে হাসপাতালগুলোর কাছেও নেই সঠিক তালিকা। হাসপাতাল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং অজ্ঞাত মরদেহ দাফনে কাজ করা আঞ্জুমান মুফিদুলের হিসাবে রয়েছে বিস্তর গরমিল। আবার কবরস্থানের নেই সিসি ক্যামেরা, মরদেহ দাফনের রেজিস্টার খাতা নিয়ে গেছে সিটি করপোরেশন, হাসপাতাল থেকেও মরদেহের পাশাপাশি আহতদেরও রেজিস্টার খাতা জোর করে নিয়ে গেছে পুলিশ। ফলে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও সঠিক তথ্য দিতে পারছে না।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন মাহামুদুর রহমান সৈকত নামের এক শিক্ষার্থী। তার বড় বোন শাহরিনা আফরোজ কালবেলাকে বলেন, ‘আমার ভাইকে টার্গেট করে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের দুই বোনের একটাই মাত্র ভাই। আমাদের পুরো পরিবার এখন নিঃস্ব। ভাইকে হত্যার পর হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ আনতে গিয়েও পড়তে হয়েছে অনেক ঝামেলায়। আমার ভাই মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলেছেন, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে না লিখলে তারা মরদেহ নিতে দেবেন না। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে।’
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র আন্দোলনে নিহত অনেকের লাশ দাফন করা হয়েছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করা হয় কাকরাইলের আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যালয়ে। তবে গত ২৫ ও ২৬ আগস্ট পরপর দুদিন সেখানে প্রবেশের অনুমতি মেলেনি। এরপর নানাভাবে যোগাযোগ করে সেখানে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। সংস্থাটির তথ্যমতে, গত ২২ জুলাই থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৬৯টি মরদেহ দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। এর মধ্যে একটি করে লাশ এসেছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এবং ফিলিস্তিন দূতাবাস থেকে। বাকিগুলো ঢাকার চারটি হাসপাতালের।
আঞ্জুমানের তথ্যমতে, এসব মরদেহ রাজধানীর রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এসব মরদেহের মধ্যে ২২ জুলাই ১১টি, ২৩ জুলাই একটি, ২৪ জুলাই ৯টি, ২৫ জুলাই তিনটি, ২৭ জুলাই সাতটি, ২৮ জুলাই ১১টি, ২৯ জুলাই একটি ও ৩১ জুলাই তিনটি মরদেহ দাফন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে ১৪ থেকে ২১ জুলাই কোনো মরদেহ দাফন করেনি তারা। এ ছাড়া আগস্ট মাসের প্রথম ২৬ দিনে তারা দাফন করেছে ২৩টি মরদেহ।
অন্তত ১০ দিন রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে খোঁজ নিয়েছে কালবেলা। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে বের করার চেষ্টা করেছে লাশ দাফনের গরমিল। তবে সাংবাদিক পরিচয়ে তারা দাফন-সংক্রান্ত কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, ১ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত যত মরদেহ দাফন করা হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই কবরস্থান কর্তৃপক্ষের কাছে। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন দায়িত্বরতরা।
তারা বলছেন, ওই সময়ে সেখানে কোনো অজ্ঞাত মরদেহ দাফন করা হয়নি। যদিও আগস্টের ওই সময়েই সবচেয়ে ভয়ংকর গণহত্যা চালানো হয়। পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের গুলিতে সবচেয়ে বেশি ছাত্র-জনতা নিহত হয়। তবে দর্শনার্থী পরিচয়ে কবরস্থানে গোরখোদক এবং দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে কালবেলা।
এর মধ্যে অন্তত দুজন আনসার সদস্য বলেছেন ওই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা। তারা বলেন, ‘আগস্টে প্রচুর মরদেহ এসেছে। এগুলো এখানেই দাফন করা হয়েছে।’
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের তথ্যমতে, তারা যেসব মরদেহ সংগ্রহ করেছে তা মূলত ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড মেডিকেল, শহীদ তাজুদ্দিন মেডিকেল থেকে। মেডিকেল ছাড়া বাইরে থেকে তারা কোনো মরদেহ সংগ্রহ করেনি। তবে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের দায়িত্বে থাকা রামু চন্দ্র দাস কালবেলাকে বলেছেন, তারা মাত্র আটটি মরদেহ শাহবাগ থানাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। শাহবাগ থানার বর্তমান অফিসার ইনচার্জ শাহাবুদ্দিন শাহিন সেই মরদেহ আঞ্জুমানকে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
আঞ্জুমানের তথ্যমতে, রায়েরবাজার কবরস্থানে মাত্র ৬৯টি মরদেহ দাফন করা হয়েছে। সাধারণত বেওয়ারিশ মরদেহ দাফনের নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে। সরেজমিন সেখানে গিয়ে ওই সময় দাফন করা ৭৫টি কবর দেখা গেছে।
আন্দোলন চলাকালে রাজধানীতে আরেকটি সংঘাতপূর্ণ এলাকা ছিল মিরপুর ১০ নম্বর। ওই এলাকা ও আশপাশের হাসপাতালগুলোয় তিন দিন ধরে ঘুরেছেন কালবেলার প্রতিনিধিরা। তবে কোনো হাসপাতালেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ও নিহতদের কোনো তথ্য নেই। কয়েকটি হাসপাতালে আগস্ট মাসের সার্বিক তথ্য রয়েছে। অন্য হাসপাতালগুলোর রেজিস্টার খাতাসহ সব তথ্য নিয়ে গেছে পল্লবী ও মিরপুর মডেল থানার পুলিশ।
একটি সূত্রের মাধ্যমে গত ২৯ আগস্ট মিরপুরের আজমল হাসপাতালের ৪ ও ৫ আগস্টে চিকিৎসা নেওয়াদের একটি অভ্যন্তরীণ তালিকা এসেছে কালবেলার হাতে। তাতে দেখা যায়, ৪ আগস্ট হাসপাতালটিতে ৬১ জন চিকিৎসা নিয়েছেন তবে কোনো মৃত্যু নেই। আর ৫ আগস্ট চিকিৎসা নিয়েছেন ৪৫ জন। এদিন হাসপাতালটিতে পাঁচজন ‘গান শর্ট ইনজুরিতে’ নিহতের তথ্য রয়েছে ওই তালিকায়। তবে সবার পরিচয় লেখা রয়েছে অজ্ঞাত।
ওই মরদেহগুলো কী করা হয়েছে—এমন প্রশ্নে হাসপাতালটির ম্যানেজার আবুল খায়ের কালবেলাকে বলেন, ‘ওই মরদেহগুলো আমরা তাদের পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি।’
কীভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘তখনই (আন্দোলন) পরিবারের সদস্যরা এসে মরদেহ নিয়ে গেছেন।’ তাহলে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ওই মরদেহগুলো আপনাদের তালিকায় অজ্ঞাত কেন—এমন প্রশ্নে বলেন, ‘আপনি কোন তালিকার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না।’
এরপর তিনি এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তবে হাসপাতাল থেকে তথ্যপ্রমাণ নিয়ে যাওয়ার তথ্য অস্বীকার করেছেন পল্লবী থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ অপূর্ব হাসান। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো তথ্য নিইনি।’
আর মিরপুর মডেল থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ সাব্বির আহমেদকে একাধিকবার ফোন ও মেসেজ করা হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ফিরে আসেননি অনেক ছাত্র-জনতা। তারা বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন—পরিবারসহ কেউই এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া শাকিল। গত ১৩ জুলাই রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর দেড় মাস পার হলেও সন্ধান মেলেনি ওই তরুণের। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলের খোঁজে বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়াদৌড়ি করছে শাকিলের পরিবার। তবে কোনো দপ্তর থেকেই পাচ্ছে না কোনো সহায়তা। উল্টো শিকার হচ্ছে হয়রানির। শাকিলকে তুলে নেওয়ার সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে কালবেলার হাতে।
তাতে দেখা যায়, শাকিলের বন্ধু অনিককে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একটি বাইকে করে। বাইকটি চালাচ্ছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ফিরোজ। পেছনে আর একটি অটোতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শাকিলকে। পরে অনিককে ছেড়ে দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত শাকিলের খোঁজ মেলেনি।
জানতে চাইলে শাকিলের বন্ধু অনিক কালবেলাকে বলেন, ‘আমাকে আর শাকিলকে মিরপুর ১৩ নম্বর পুলিশ কনভেনশন সেন্টারের পাশে অবস্থিত কাফরুল থানাধীন রাকিন সিটি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা ডিজিএফআইর পরিচয় দেয়। তারা মোট পাঁচজন ছিলেন। ফিরোজ আমাকে মোটরসাইকেলে করে ১৪ নম্বর মোড়ে এনে ছেড়ে দেয়। আর শাকিলকে অটোতে করে নিয়ে যায়।’ অনিক আরও বলেন, ‘আমরা কাফরুল থানা পুলিশের কাছে গিয়ে ঘটনা খুলে বলি। থানার সিসিটিভি ফুটেজ থেকে আমি ফিরোজকে শনাক্ত করি। পরে কাফরুল থানার এসআই রশিদ, ফিরোজের সঙ্গে ১৪ নম্বর মানিক হোটেলের পাশের সেনা কোয়ার্টারে ঘণ্টাখানেকের মতো একান্ত আলাপ করেন। কথাবার্তা শেষে এসআই রশিদ কোনো কথা না বলে চলে যান।
’
এ বিষয়ে কাফরুল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের শনাক্ত করে দেওয়ার জন্য আমি ফিরোজকে ডেকে কথা বলেছি। ফিরোজ অস্বীকার করেছেন, যে তিনি তাদের নেননি। পরে আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি।’
তবে একটি সূত্র থেকে কাফরুল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রশিদের ১১ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডের একটি অডিও এসেছে কালবেলার হাতে। সেখানে এসআই রশিদকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি বলি, ওরা ডিজিএফআই এফএস মানে ফিল্ড সোর্স। ওদের কাজই এগুলা। আমি তো ৩টা বছর র্যাবে থাইকা আইছি, আমি তো জানি। আমি তো ওদের সঙ্গে থাকছি।’
রশিদকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘আমি আপনাদের সামনে বলতেছি, আমি একশ পার্সেন্ট শিওর তারাই (ডিজিএফআই) কাজটা করছে। আপনাদের কাছে একটা কথাই বলতেছি, যদি ডিজিএফআই ছেলেকে না নিত, অন্য কোনো পাবলিক ফাংশন হতো, তাহলে কবে শাকিলকে উদ্ধার করে ফেলতাম।’
আন্দোলন সময়ে যারা নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) সম্পর্কিত তথ্যের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়। তবে শুরুতে আশ্বাস দিয়েও শেষ পর্যন্ত তারা কোনো তথ্য দেননি।