গ্রেফতার হয়ে রিমান্ডে নেয়ার পর থেকেই নির্বাক ছিলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। তবে ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন তিনি। রিমান্ডের ৫ম দিনে জিজ্ঞাসাবাদে আব্দুল্লাহ আল-মামুন জানান, গণ-আন্দোলনে রূপ নেবে কোটা সংস্কার আন্দোলন- এমন গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ার পরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন।
সেই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন তিনি। এরপরই শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয় পুলিশকে। গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে রিমান্ডে আছেন সাবেক এই আইজিপি। চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, আন্দোলনের সময় পরিস্থিতি বুঝে কঠোরতা প্রদর্শনের জন্য ডিএমপি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। আর ছাত্রলীগ করে আসা পুলিশ কর্মকর্তাদের মাঠে সক্রিয় হওয়ার জন্য বলা হয়।
এরপর পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কঠোরতা প্রদর্শনের নির্দেশ দেওয়া হলে নির্বিচারে ছাত্র-জনতার ওপর গুলির ঘটনা ঘটে, যা গণহত্যায় রূপ নেয়। পরে আর মাঠ পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে বিমর্ষ হয়ে পড়েন সাবেক আইজিপি মামুন। তিনি বলেন, দ্বিতীয় দফায় চুক্তিভিত্তিক আইজিপি হতে ইচ্ছে ছিল না।
এতে করে বাহিনীতে চেইন অব কমান্ডে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। কাউকে বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা এড়াতে পারিনি। সেদিন যদি নারাজি দিতাম তাহলে হয়তো আমি এই গণহত্যার দায়মুক্ত থাকতাম। একাধিক তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারের পর থেকে জিজ্ঞাসাবাদে নির্বাক রয়েছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। কোনোভাবেই গণহত্যার দায় এড়াতে পারেননি।
তবে তিনি দাবি করেছেন- ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে মাঠ পুলিশ তার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। রাজনৈতিক বিবেচনায় ভূমিকা নেয় মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা, বিশেষ করে ডিএমপি। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি, দমন-পীড়নে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
পাশাপাশি আন্দোলন সংক্রান্ত অনেক বিষয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে। মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। রিমান্ড শেষে প্রাপ্ত তথ্য আদালতকে জানানো হবে। তাদের আরো অনেক বিষয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হতে পারে। গ্রেফতার হতে পারেন নতুন মামলায়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ছাত্রদের হাতে শুরু হওয়া আন্দোলন দমন-পীড়নের কারণে গণ-আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। এই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। গণহত্যায় তৎকালীন সরকারের চাপ আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ন্যায় পুলিশকে ব্যবহার করা হিতে বিপরীত হয়েছে। আজ পুলিশের ভূমিকা ও ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতার রোষ পড়ে পুলিশের ওপর।
এ দায় তৎকালীন পুলিশ প্রধান এড়াতে পারেন না। তিনি বলেন, আন্দোলন দমনের নামে গণহত্যা চালানোর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা হয়েছিল কিনা, শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে কী ধরনের চাপ ছিল, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। এসব প্রশ্ন শুনে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন সাবেক আইজিপি মামুন স্যার।
তিনি বলেন- আন্দোলন দমনের চাপ ছিল, নির্দেশনাও ছিল। কিন্তু শেষের দিকে আন্দোলন যেমন নিয়ন্ত্রণে ছিল না তেমনি বাহিনীও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে পৃথক হত্যা মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হককে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সেনা হেফাজতে ছিলেন।
তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তিনি সেনা হেফাজতে থাকা অবস্থায় আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রাতেই তাকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। পরদিন ৪ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পৃথক হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ১০ দিন করে রিমান্ড অনুমতি চেয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মুদি দোকানি আবু সায়েদ হত্যা মামলায় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব